বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত। শিক্ষা, বানিজ্য, প্রযুক্তি প্রভৃতি দিক থেকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতবেগে। কিন্তু এখনও দেশের গরীব জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত পরিবারের শহর এমনকি গ্রামেও যথাযথ বাসস্থানের সঙ্কুলান করতে কর্তৃপক্ষের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মধ্যে নিম্ন আয়ের জনগণ সব থেকে বেশী ভুক্তভোগী। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের আবাসনের সমস্যার সমাধান করতে হলে সরকারের প্রতক্ষ্য ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের জনসংখ্যা আয়তনের তুলনায় বেশী। এজন্য এই সমস্যা আরো বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলেও সংবিধান অনুযায়ী যথাযথ বাসস্থান নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। যথাযথ বাসস্থান বলতে নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত টেকসই বাড়ী বোঝায় যেখানে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা থাকবে। অতীতে সরকারের উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার কিছু কিছু সফলতা লাভ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পূর্বাচলে আবাসন প্রকল্প। এখানে স্বল্প মূল্যে যাদের বাসস্থান দরকার তাদের জন্য ব্যবস্থা করার পদক্ষেপ নিলেও কিছু নির্দিষ্ট মানুষ লাভবান হয়। এর জন্য অনেকে শুধু দূর্নীতি কে দোষারোপ করলেও আরো অনেক বিষয় দৃষ্টির অগোচরে থেকে গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাসস্থান প্রদানের পূর্বে অনেক বিষয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। যেমন, যে শ্রেনীর মানুষের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয় তাদের চাহিদা, নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা ও সামর্থ্য। একটি বাসস্থানে পর্যাপ্ত স্যানিটেশন, ভেন্টিলেশন ও পানির ব্যবস্থা মৌলিক বিষয়। কিন্তু এর সাথে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বাড়ীর নকশা নির্ভর করে। আধুনিক সুবিধা বিশিষ্ট বাড়ী যা বানাতে ১০০ টাকা খরচ হয়, তা সরকারের ভর্তুকী দ্বারা মানুষের জন্য ৮০ টাকায় কেনার ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু সরকারের টার্গেট গ্রুপ অর্থাৎ যাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে এই ভর্তুকি দেয়া তাদের বাড়ী কেনার জন্য সর্বোচ্চ সামর্থ্য ৫০ টাকা হলে সম্পূর্ণ প্রকল্প বৃথা যায়। তখন যাদের ১০০ টাকা দিয়েই বাড়ী কিনবার সামর্থ্য ছিল তারা লাভবান হয়। এমনকি যাদের এরূপ আবাসনের প্রয়োজনও নেই তারা কিনে ভাড়া দিয়ে লাভবান হয়। আবার অনেক সময় ১০০ টাকার বাড়ী ৮০ টাকায় সামর্থ্যহীন মানুষ ধার করে কিনলেও তা পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রনের সামর্থ্য তাদের থাকে না। কিন্তু তাই বলে মানহীন, টেকসই নয় এরূপ বাড়ী প্রাদান করা লক্ষ্য নয়। তাই এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, বাসস্থানের ফ্লোর এরিয়া বা ক্ষেত্রফল সুনিশ্চিত করা। জাপানে একটি গবেষণা করা হয় যেখানে একজন মানুষের সুসাস্থ ও মনন নিশ্চিত করতে নূন্যতম কত ফ্লোর এরিয়ার বাড়ী হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা করে। তাদের পারিপার্শিক অবস্থা ও সংস্কৃতি অনুযায়ী শহরে একজনের বসবাসের জন্য ৪৩০ বর্গফুট বাড়ী প্রয়োজন। জাপানে বাড়ী নির্মানের নির্দেশিকায় এর উল্লেখ রয়েছে। অপরদিকে মানুষের নিজ মতামতে একজনের জন্য নিজস্ব বাসার ক্ষেত্রে ৪৫০ থেকে ৫৫০ বর্গফুট ও ভাড়া বাসার ক্ষেত্রে ৫৫০ থেকে ৬৫০ বর্গফুট বাড়ী হলে তারা তৃপ্তিসহ থাকতে পারে। এখন বাংলাদেশে জাপানের সাথে তুলনা করে বাড়ী প্রদান করা সম্ভব না হলেও নূন্যতম স্ট্যান্ডার্ড লক্ষ্য করা উচিত। কেননা এখানে উল্লেখযোগ্য যে একটি মানুষের সম্পূর্ণ বিকাশ, তার স্বাস্থ্য, মানষিক স্বাস্থ্য আবাসস্থলের উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে। WHO দ্বারা গবেষণার দ্বারা দেখা যায় এদের মাঝে সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান। অসুস্থতার হারের সাথে সাথে শিশু মৃত্যুহার, কিশোর অপরাধ ও শিশুর উচ্চতার মত বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের গড় পারিবারিক সদস্য সংখ্যা ৪.৫ জন। একটি পরিবারে চার জন মানুষের স্থান সঙ্কুলানের জন্য নূন্যতম ৫০০ বর্গফুট বাড়ী দরকার। প্রকৃতপক্ষে নিম্ন আয়ের জনগণের চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী এটি নির্ভর করে। এক্ষেত্রে বেশ কিছু বিকল্পের ব্যবস্থা থাকলে তারা বেছে নিবার সুযোগ পায়।
তৃতীয়ত, বাসস্থানের ঠিকানা। নিম্ন আয়ের মানুষেরা বিশেষত যারা শহরে বসবাস করে তাদের জন্য বাড়ীর ঠিকানা অনেক গুরুত্বপূর্ন। কর্মস্থল থেকে বসতবাড়ীর অবস্থান দূরে হলে প্রদানকৃত বাড়ী গ্রহণে অনেকেই আগ্রহ হারাবে। অধিকাংশ মানুষ আমাদের দেশে আবাসস্থলের জন্য মাসিক আয়ের শতকরা ৪০ ভাগ বাড়ী ভাড়ার জন্য ব্যয় করে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা ৬০ ভাগ ও হয়। খুব আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্য যে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকায় বিভিন্ন শ্রেনীর জনগণের ক্ষেত্রে মাসিক আয়ের সাথে প্রতি বর্গফুটে বাড়ী ভাড়ার পেছনে খরচের পরিমাণের সম্পর্ক্য ব্যস্তানুপাতিক। নিম্ন আয়ের পরিবারকে প্রতি বর্গফুটে বেতনের সব থেকে বেশী অংশ বাড়ী ভাড়ায় ব্যয় করতে হয়। কেননা আয়ের তুলনায় বাড়ীর ভাড়া অনেক বেশী। নিম্ন আয়ের মানুষের বাড়ী ভাড়ার জন্য বেশী খরচ করতে হয়। যার ফলে তাদের কাছে অন্যান্য বিষয়ে যেমন, চিকিৎসা, খাদ্য, অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ, সন্তানের শিক্ষা এবং আমাদের আলোচনায় সব থেকে জরুরি যাতায়াত ক্ষেত্রে খরচের অংশ কমিয়ে দিতে হয়। যাতায়াত ক্ষেত্র জরুরি কেননা যাতায়াত নির্ভর করে বাসস্থানের অবস্থানের উপর। যাতায়াতের জন্য বাস নিম্ন আয়ের জন্য প্রধান মাধ্যম। বাসে সব থেকে কম খরচ হলেও নিম্ন আয়ের জন্য খরচ ও দূরত্ব দুটোই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা সকলেই বাসস্থান থেকে কর্মস্থলের দূরত্ব কম হওয়াকে প্রাধান্য দেয়। এমনকি গবেষণায় দেখা যায় বাড়ীর অবস্থান ঠিক করতে সবার প্রথমে সন্তানের বিদ্যালয়ের ঠিকানাকে সব থেকে বেশী প্রাধান্য দেয়া হয়। তাই নিম্ন আয়ের জনগণের জন্য বাসস্থান প্রদান করতে হলে বাসস্থানের অবস্থান শহর ও গ্রামীণ উভয় ক্ষেত্রেই লক্ষ্য রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
নিম্ন আয়ের পরিবারের আবাসনের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া অত্যান্ত জরুরি। কেননা তাদের পক্ষে নিজ ভূমিকায় আবাসনের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। বাড়ী ভাড়া যেভাবে বাড়ছে তাতে খুব দ্রুত আবাসনের সামর্থ্য অধিকাংশ নিম্ন আয়ের পরিবারের লোপ পাবে। এক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপে ভর্তুকি দিয়ে বিভিন্ন সেটেলমেন্ট ডেভেলপমেন্টের উপায়ে আবাসনের ব্যবস্থা করা জরুরি। যেমন, উপযুক্ত জায়গায় আবাসন নির্মাণ করে দেয়া। এই জায়গা সরকারী জমি বা কিছু জমির মালিকের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বাড়ী বানিয়ে তা জমির মালিক ও অন্যান্য জনগণের মাঝে বন্টন করে দেয়া যায়। এই বাড়ী এককিস্তিতে ক্রয় করার সামর্থ্য অধিকাংশ নিম্ন আয়ের পরিবারের নাও থাকতে পারে। যেমন, ৫০০ বর্গফুটের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা বিশিষ্ট বাড়ী বানাতে প্রতি বর্গফুটে ১০০০ টাকা খরচ হলে মোট ৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়। যা তাদের জন্য বহন করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সঠিক সুদ বিশিষ্ট লোনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আবার লোন পরিশোধ করতে না পারলে এমনকি অন্য কোন কারণেও বাড়ী হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম জারি করতে হবে যাতে অসৎ ভাবে কেউ এর লাভ নিতে না পারে।
বর্তমানে জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ এ উল্লেখ করা হয়েছে গৃহায়নের ক্ষেত্রে মোট সম্পদের ১.৩% ব্যবহার করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর “সবার জন্য আবাসন, কেউ থাকবে না গৃহহীন” প্রতিশ্রুতিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ৬,৬০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। এস.ডি.জি এর আওতায়েও যে গৃহায়ন এর লক্ষ্য নিশ্চিত করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য ৭ম পাঁচবর্ষী মেয়াদ প্ল্যানে পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। এসব কিছুরই আওতায় নিম্ন আয়ের জনগণের আবাসন রয়েছে। পরিশেষে, নিম্ন আয়ের পরিবারের আবাসনের জন্য শুধু পরিকল্পনাই নয় সঠিক বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করা জরুরি।